যে কোনো সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টায় ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত শক্তিশালী উপাদান। এটি এমন এক শক্তি যা প্রতিষ্ঠানের সকল উপায়-উপকরণকে কার্যকরভাবে সংগঠিত ও লক্ষ্যপানে পরিচালিত করে। ব্যবস্থাপনাকার্য দক্ষতা ও যোগ্যতার সাথে পরিচালিত হলে তা যেমনি প্রতিষ্ঠানকে সফলতা দান করে তেমনি ব্যবস্থাপনা কার্যে অদক্ষতা প্রদর্শিত হলে উপায়-উপকরণ যত উন্নত হোক না কেন তা কোনো কার্যকর ফল দিতে পারে না । পাশাপাশি দু'টি হাসপাতাল । একই পরিমাণ মূলধন ও ভৌত সুযোগ-সুবিধা নিয়ে প্রতিষ্ঠান দু'টি যাত্রা শুরু করেছিল। একটা এগিয়ে যাচ্ছে ও অন্যটা পিছিয়ে পড়ছে। পার্থক্যের কারণ খুঁজলে দেখা যাবে একটার ব্যবস্থাপনা অন্যটির চেয়ে উত্তম । একই এলাকায় একাধিক কলেজ রয়েছে । দেখা যাবে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরা কোনো কলেজে ভিড় জমাচ্ছে । কারণ ঐ কলেজটির ব্যবস্থাপনা অন্যটির চেয়ে ভালো । এভাবেই প্রতিটা পরিবার, সমাজ, প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্রসহ সর্বত্রই সঠিক পরিচালনা বা ব্যবস্থাপনার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । নিম্নে ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব আলোচনা করা হলো:
১. উপকরণাদির সুষ্ঠু ব্যবহার (Proper utilization of resources) : উপকরণ বলতে কার্যসম্পাদনের জন্য ব্যবহার্য বস্তকে বুঝায় । তাই উৎপাদনের কাজে লাগে এমন প্রয়োজনীয় বস্তুকে উৎপাদনের উপকরণ বলে । ভূমি, শ্রম, মূলধন ইত্যাদি উপকরণ কোথাও থাকাই উৎপাদনের জন্য যথেষ্ট নয় । এগুলোর যথাযথ ব্যবহারের জন্য যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তাই ব্যবস্থাপনা । Terry ও Franklin বলেছেন, “ব্যবস্থাপনা হলো সেই ধরনের কাজ যা অসংগঠিত মানুষ ও বস্তুগত সম্পদকে ব্যবহারযোগ্য ও ফলদায়ক পরিণতির দিকে নিয়ে যায়।” একজন ভালো কৃষক ভূমি, শ্রম, মূলধন, ট্রাক্টর, সেচযন্ত্র, সার, বীজ ইত্যাদির কার্যকর ব্যবহার করে অধিক ফসল ফলিয়ে উন্নয়ন নিশ্চিত করে । একজন শিল্পমালিক তার জনশক্তি, যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল, অর্থ, বাজার, পদ্ধতি ইত্যাদির সঠিক ব্যবহার করে শিল্পকে এগিয়ে নেয়। একজন সফল রাষ্ট্রপ্রধান যোগ্য নেতৃত্বদানের মাধ্যমে সবার মধ্যে আশাবাদ সৃষ্টি এবং প্রশাসনের সর্বস্তরে গতিশীলতা এনে দেশের সকল সম্ভাবনাকে কাজে লাগায় । তাই উপকরণের কার্যকর ব্যবহারে যোগ্য ব্যবস্থাপনার বা ব্যবস্থাপকের বিকল্প নেই।
২. দক্ষতা বৃদ্ধি (Increase of efficiency) : দক্ষতা হলো কম খরচ (Input) এ বেশি কাজ বা ফল (Output) লাভের সামর্থ্য। সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করতে পারাও দক্ষতা হিসেবে গণ্য। ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানের কাজের দক্ষতা বৃদ্ধি করে। কারণ উত্তম ব্যবস্থাপনার অধীনে এর প্রতিটা জনশক্তির দক্ষতা বাড়ে। ফলে বস্তুগত উপকরণ; যেমন- যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল, মূলধন ইত্যাদির দক্ষতাও বৃদ্ধি পায়। পাশাপাশি একই ধরনের ও মানের দু'টি প্রতিষ্ঠান। একটা প্রতিষ্ঠানে কর্মীরা একই সময়ে যে পরিমাণ উৎপাদন করে অন্য প্রতিষ্ঠানে তার চেয়ে কম উৎপাদন হয় । এতে প্রথম প্রতিষ্ঠানটি প্রতিযোগিতায় ভালো করবে । সেখানে অপচয় হ্রাস পাবে এবং মুনাফার পরিমাণ বাড়বে । অন্যদিকে পরের প্রতিষ্ঠানটিতে পূর্ববৎ অবস্থা চলতে থাকলে একদিন প্রতিযোগিতার বাজারে তা পিছিয়ে পড়বে । তাই একটা প্রতিষ্ঠানের সার্বিক দক্ষতা ব্যবস্থাপনার ভাল-মন্দের ওপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল ।
৩. শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা (Establishment of discipline) : শৃঙ্খলা বলতে রীতি, নিয়ম, নীতি, সুব্যবস্থা ইত্যাদিকে বুঝায় । একটা প্রতিষ্ঠানে যদি এগুলো না থাকে তবে ঐ প্রতিষ্ঠান কখনই ভালো চলতে পারে না। একটা পরিবারের কথাই ধরা যাক, যেখানে যদি কোনো নিয়ম-রীতি না থাকে, যে যার মতো চলে, কোনো মান্যতা ও ভব্যতা না থাকে তবে শান্তি ও উন্নতি সেখানে আশা করা যায় না । একটা প্রতিষ্ঠান, সমাজ, রাষ্ট্র ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রেই এ বিষয়টি প্রযোজ্য । একটা প্রতিষ্ঠানে এই শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব থাকে মূলত পরিচালক বা ব্যবস্থাপকগণের ওপর । তারা যদি তাদের কাজের মধ্য দিয়ে সর্বক্ষেত্রে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হন তবে ঐ প্রতিষ্ঠান ভালো চলতে পারে না । আমাদের দেশে সর্বক্ষেত্রে যে বিশৃঙ্খলা লক্ষণীয় এর পিছনে মূল কারণ হলো ব্যবস্থাপনা বা প্রশাসনের অদক্ষতা ।
৪. উত্তম সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা (Establishment of cordial relationship) : একটা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষ; যেমন- মালিক, ব্যবস্থাপক, শ্রমিক-কর্মী, ক্রেতা ও ভোক্তা, সরবরাহকারী ইত্যাদি সবার সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক থাকা বর্তমানকালে খুবই গুরুত্বপূর্ণ । একটা প্রতিষ্ঠানের দক্ষ ব্যবস্থাপনাই শুধুমাত্র তা নিশ্চিত করতে পারে । একটা পরিবারে বাবা-মার মধ্যে যদি উত্তম সম্পর্ক না থাকে তবে ঐ পরিবারে অশান্তির শেষ থাকে না । সন্তানদের মধ্যেও অস্থিরতা ও অস্বাভাবিকতা জন্ম নেয় । একটা প্রতিষ্ঠানেও এ কথা সর্বোতভাবে প্রযোজ্য । মালিক বা ব্যবস্থাপকদের মধ্যে যদি পারস্পরিক সম্পর্কের অভাব থাকে, গ্রুপিং-লবিং যদি নিত্যকার বিষয় হয় তবে নিচের স্তরে কর্মরত শ্রমিক-কর্মীরা তার দ্বারা দ্রুত প্রভাবিত হয়ে থাকে । এতে প্রতিষ্ঠানের স্বাভাবিক, স্বচ্ছন্দ ও কর্মমুখী পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় । একটা প্রতিষ্ঠানের দক্ষ ব্যবস্থাপনাই শুধু সর্বস্তরে উত্তম সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে সে অবস্থা থেকে প্রতিষ্ঠানকে সুরক্ষাদান ও সামনে এগিয়ে নিতে পারে ।
৫. কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি (Creation of employment opportunity) : কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি বলতে মানুষকে কাজে লাগানোর মতো নতুন নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টিকে বুঝায় । উত্তম ব্যবস্থাপনা শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নই নিশ্চিত করে না ব্যবসায় সম্প্রসারণ ও নতুন নতুন ব্যবসায় গঠনের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশে স্কয়ার গ্রুপ, আকিজ গ্রুপ, প্রাণ গ্রুপসহ যে সকল প্রতিষ্ঠান দেশকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে- তা তাদের ব্যবস্থাপনার দক্ষতার কারণেই সম্ভব হয়েছে । বাংলাদেশের গার্মেন্টস ব্যবসায়ীগণের অনেকেই তাদের ব্যবস্থাপনার দক্ষতার কারণে নানান সীমাবদ্ধতার মধ্যেও নতুন নতুন কারখানা গড়ে হাজারো শ্রমিকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে সমর্থ হয়েছেন । এতে দেশে যেমনি বেকার সমস্যার লাঘব হচ্ছে সেই সাথে মানুষের আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশ ও সমাজ উপকৃত হচ্ছে ।
আরও দেখুন...